প্রত্যেক অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনুন
মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে মার্কিন দূতাবাস সম্প্রতি যে মামলা করেছে, সেটি সুষ্ঠ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি রাখে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ১১ ফেব্রুয়ারি মফিজুর রহমান ও আশরাফুল আলম ভূঁইয়া নামের দুই বাংলাদেশি মার্কিন ভিসার জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে স্বীকার করেছেন, তাঁরা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে মানব পাচারে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য তাঁরা দূতাবাসে ভুয়া নথিও জমা দিয়েছিলেন।
উল্লিখিত দুজনের একজন স্বীকার করেছেন, তাঁকে অর্থের বিনিময়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একজন অভিবাসন কর্মকর্তা সাহায্য করেন। এর অর্থ মানব পাচারের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারাও জড়িত। যেখানে রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সেখানে মানব পাচার বন্ধ হবে কী করে?
এর পাশাপাশি ২৩ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এ মানব পাচারের আরেকটি খবর ছাপা হয়। এতে বলা হয়, বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য গিয়ে অনেক বাংলাদেশি তরুণ লিবিয়ায় পাচারকারী চক্রের হাতে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন। দেশ থেকে স্বজনেরা মোটা অঙ্কের টাকা পাঠালেই কেবল তাঁরা ছাড়া পান। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া বিদেশে গিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করেছেন, ২০২২ সালে এ রকম ৬২৯ জনকে উদ্ধার করে দেশে ফেরত এনেছে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি। ইউরোপে লোভনীয় চাকরি দেওয়ার নাম করে তাঁদের লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
ইউএনএইচসিআরের মতে, সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়া ৫ হাজার ২৩৬ জন শরণার্থী ও অভিবাসী কর্মীর ১৩ শতাংশই বাংলাদেশের নাগরিক। ১৫ ফেব্রুয়ারি তিউনিসিয়া উপকূলে ভূমধ্যসাগরে ৫২ জন অভিবাসীসহ একটি নৌকায় আগুন লেগে ডুবে গেলে ৮ বাংলাদেশি মারা যান। অপর ২৬ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। একজন গুরুতর আহত হন।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম লিবিয়াভিত্তিক এক পাচারকারীকে শনাক্ত করে বলেছে, ওই ব্যক্তি সারা দেশে ৪০ জন দালাল নিয়োগ করেছেন, যাদের কাজ হলো বিদেশে গমনে ইচ্ছুক তরুণদের খুঁজে বের করা। গত ১১ জানুয়ারি প্রথম আলোর প্রতিবেদনে মানব পাচার মামলার যে চিত্র উঠে এসেছে, তা খুবই হতাশাজনক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গত বছরের মানব পাচার-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর—এই ৯ মাসে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে করা ৩৩২ মামলার বিচার বিভিন্ন আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৩১৬ মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন, যা মোট মামলার ৯৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। ১৬ মামলায় ৫৬ জনের শাস্তি হয়েছে, যার মধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মাত্র দুজনের।
সাভারের এক ভুক্তভোগী নারীর বাবা জানান, কানাডায় নেওয়ার নাম করে ভারতে তাঁর মেয়েকে পাচার করার দায়ে তিনি যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন, তাঁরা সবাই ছাড়া পেয়েছেন। উল্টো বিবাদীদের করা মামলায় তাঁকে চার মাস জেল খাটতে হয়েছে। মানব পাচার মামলাগুলোয় অপরাধীরা শাস্তি পান না তথ্যপ্রমাণের অভাবে। এ ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতি আছে। অনেক সময় পাচারকারীদের সঙ্গে গোপন লেনদেনের কারণ মামলার তথ্য-প্রমাণ মুছে ফেলা হয় বলেও অভিযোগ আছে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী যথার্থই বলেছেন, মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় মামলার তদন্ত সঠিকভাবে হয় না। তাঁরা ভুক্তভোগীদের হুমকি দিয়ে আপস-মীমাংসা করে ফেলেন।
বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার বন্ধ করতে হলে প্রথমত, সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বোচ্চ সজাগ থাকতে হবে, যাতে পাচারকারীরা কাউকে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে বিদেশে পাঠাতে না পারেন। দ্বিতীয়ত, মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।